লাইলাতুল কদরের তিনটি বৈশিষ্ট্য:

লাইলাতুল কদরের তিনটি বৈশিষ্ট্য:


১. এ রাতে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নাযিল করা হয়েছে।

২. এ রাত হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।

৩. এ রাতে হযরত জিবরাঈল আ. ফেরেশতাদের এক দলসহ জমিনে অবতরণ করেন।

সূরা কদরে আল্লাহ তাআলা এ তিনটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। ইবনে আবী হাতেম রাযি. থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. একবার বনী ইসরাঈলের জনৈক মুজাহিদ সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন যে, সে এক হাজার মাস পর্যন্ত অবিরাম জিহাদে মশগুল থাকে এবং কখনো অস্ত্র সংবরণ করেনি। সাহাবায়ে কেরাম একথা শুনে কিছুটা ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। এর কারণ, তাঁরা চিন্তা করলেন আমরা শেষ যামানার নবীর উম্মত। আমাদের গড় আয়ু ষাট-পয়ষট্টি বছর। আর আগের উম্মতেরা একাধারে জিহাদের মত গুরুত্বপূর্ণ আমলই করেছে এক হাজার মাস। আমরা বেশি হায়াত লাভ করলে বেশি বেশি ইবাদত করতে পারতাম। আল্লাহ এই উম্মতের উপর কত মেহেরবান! সাথে সাথে হযরত জিবরাঈল আ.-কে সূরা কদর দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। হযরত জিবরাঈল হাজির হয়ে রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিকট পায়গাম পৌঁছিয়ে দিলেন:

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ

"নিশ্চয় আমি এ কুরআনকে লাইলাতুল কদরে অবতীর্ণ করেছি।"

ততক্ষণ পর্যন্ত লাইলাতুল কদর সম্পর্কে না নবী কিছু জানেন, না সাহাবায়ে কেরাম। আল্লাহ ঘোষণা করলেন, আমি এ কুরআনকে লাইলাতুল কদরে নাযিল করেছি।

লাইলাতুল কদরের ফযীলত বুঝার জন্য এ একটি আয়াতই যথেষ্ট। কারণ, এ রাতে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নাযিল করা হয়েছে। আল-কুরআন সম্পর্কে হাদীছে আছে:

الْقُرْآنُ أَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنَ السَّمَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَنْ فِيهِنَّ

(دارمی، فضائل القرآن فضل كلام الله على سائر الكلام، ٥٣٤/٢، رقم : ٣٣٥٨)

"আসমান জমিন এবং এদুয়ের মাঝে যা কিছু আছে এসব কিছু থেকে কুরআনই হলো আল্লাহ'র কাছে অধিক প্রিয়।"

ঐ/লাইলাতুল কদর সম্পর্কে আগ্রহী

হওয়ার জন্য আল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন: وَمَا أَدْرَى كَمَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ

"আপনি (মুহাম্মাদ সা.) কি জানেন, লাইলাতুল কদর কী জিনিস?"

রাসূলুল্লাহ তখনও লাইলাতুল কদরের সাথে পরিচিত নন। তারপরও তাঁকে জিজ্ঞেস করার অর্থ হলো অধিক আগ্রহ সৃষ্টি করা। তাই জিজ্ঞেস করার সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা এর কয়েকটি ফযীলত বর্ণনা করলেন:

۵. لَةَ القَدَر خَيْرٌ مِنْ اَلْفِ شَهْر "লাইলাতুল কদর হাজার মাস থেকে উত্তম।" বনী ইসরাঈলের সে আবেদের কথা শুনে মুসলমানদের মনে ইবাদতের যে আগ্রহ জমেছিল, যে বঞ্চনাবোধের সৃষ্টি হয়েছিল আল্লাহ তার সমাধান দিয়ে বললেন, লাইলাতুল কদর হাজার মাস থেকে উত্তম। অর্থাৎ, হাজার মাস একাধারে ইবাদতে কাটালে যে সওয়াব, এ এক রাতের ইবাদতে তার চেয়ে বেশি সওয়াব। আর এই বেশির পরিমাণ যে কত, তা একমাত্র আল্লাহই জানেন।

এখন কারো ভাগ্যে যদি এমন দশটি রাত জুটে যায়। অর্থাৎ, দশটি বছর যদি কেউ এমন রাত পেয়ে যায়, আর তিনি এ রাতসমূহে ইবাদতে মশগুল থাকেন বা দান সদকা করেন, তাহলে তার অর্থ হলো তিনি হাজার বছরের বেশী সময় ইবাদতে কাটাবার সওয়াব লাভ করেছেন।

২. এ রাতের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো:

تَنَزَّلُ الْمَلئِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ -

"এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ফেরেশতাগণ ও হযরত জিবরাঈল আমীন তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে অবতীর্ণ হন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে এখানে তাকদীর সংক্রান্ত বিষয় বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, এ রাতে পরবর্তী এক বছরের অবধারিত বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফেরেশতাগণের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিযিক, বৃষ্টি ইত্যাদির পরিমাণ নির্দিষ্ট ফেরেশতাগণকে লিখে দেয়া হয়। 

হযরত জিবরাঈল আমীন ফেরেশতাদেরকে নিয়ে কেন আসেন, কী করেন, হাদীছে এর বিবরণ এভাবে এসেছে:

إِذَا كَانَ لَيْلَةُ الْقَدْرِ نَزَلَ جِبْرَائِيلُ عَلَيْهِ السَّلَامُ فِي كَبُكَبَةٍ مِنَ الْمَلِئِكَةِ يُصَلُّونَ

عَلَى كُلِّ عَبْدٍ قَائِمٍ أَوْ قَاعِدٍ يَذْكُرُ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ - (شعب الايمان للبيهقي، رقم: ۳۷۱۷)

"রাসূল কারীম সা. ইরশাদ করেন, লাইলাতুল কদর উপস্থিত হলে হযরত জিবরাঈল আ. একদল ফেরেশতাসহ পৃথিবীতে নেমে আসেন এবং এ রাতে যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে কিংবা বসে আল্লাহ'র যিকরে মশগুল থাকে তাদের জন্য দু'আ করতে থাকেন।"

অন্য হাদীছে আরও বিস্তারিত এসেছে যে, এ রাতে হযরত জিবরাঈল আমীন ফেরেশতাদের এক বিরাট জামা'আত নিয়ে জমিনে অবতরণ করেন। তাদের সঙ্গে সবুজ রঙের একটা ঝাণ্ডা থাকে যা কা'বা শরীফের উপর উড্ডীন করে দিয়ে ফেরেশতাগণ পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েন এবং আল্লাহ'র বান্দা-বান্দীরা যে যেখানে যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে বসে আল্লাহ'র ইবাদতে মশগুল থাকে, দু'আ করে, তাদেরকে তাঁরা সালাম করে, তাঁদের সাথে মুসাফাহা করে এবং তাঁদের দু'আয় আমীন, আমীন বলতে থাকে।

৩. এ রাতের তৃতীয় ফযীলত আর বৈশিষ্ট্য হলো: এ অর্থাৎ, এ রাত শান্তিই শান্তি, মঙ্গলই মঙ্গল। এতে অনিষ্টের কোন নাম-নিশানা নেই। আল্লাহ বলেন : هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ অর্থাৎ, সুবহে সাদেক পর্যন্ত এ অবস্থা বহাল থাকে।

এর দ্বারা বুঝা গেল যে, লাইলাতুল কদরের ফযীলত এবং বরকত সুবহে সাদেক পর্যন্ত বাকী থাকে। এখন দেখা যায় কিছু লোক ফজরের নামাযে এসে বসে থাকে যে, ফজরের পর হুযূর দীর্ঘক্ষণ দু'আ করবেন আর আমরা আমীন, আমীন বলবো, এতেই লাইলাতুল কদর হয়ে যাবে। অনেক মসজিদে এ রকম দেখা যায় যে, ইমাম সাহেবগণ ফজরের নামাযান্তে মুসল্লীদের নিয়ে লম্বা লম্বা মুনাজাত করেন, এটা ঠিক নয়। কারণ এ মুনাজাত কিসের? যদি লাইলাতুল কদরের জন্য হয়ে থাকে, তা হলে তা তো চলে গেছে সুবহে সাদেক হওয়ার সাথে সাথেই। ফজরের আযান হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে লাইলাতুল কদর শেষ হয়ে গেছে। সুতরাং দু'আ, মুনাজাত, ইবদাত-বন্দেগী যা করার তা ফজরের আগেই শেষ করতে হবে। ফজরের নামাযের পরে লম্বা দু'আর কোন ফযীলত নেই; বরং সারারাত যারা ইবাদতে কাটিয়েছেন, এ দীর্ঘ মুনাজাত দিয়ে তাদের উপর জুলুম করা হয়। এটা জাহালতের কারণে হয়ে থাকে।

যাই হোক, এ মহামূল্যবান রাতকে আল্লাহ তাআলা তাঁর বিশেষ হিকমাতের কারণেই অনির্দিষ্ট রেখেছেন। এ হিকমাত সম্পর্কে উলামায়ে কেরাম কয়েকটি মতামত ব্যক্ত করেছেন।

. লাইলাতুল কদর নির্দিষ্ট করে দিলে একশ্রেণীর লোক সারা বছর ঐ একটি মাত্র রাতের অপেক্ষায় থাকতো। মনে করতো, এখন যা করার করি-লাইলাতুল কদর আসলে ইবাদত করবো। তাতে সব গুণাহ মাফ হয়ে যাবে। অথচ এ রাত পর্যন্ত সে জীবিত থাকবে কি-না, তা সে জানে না। এভাবে সে লাইলাতুল কদরের অপেক্ষায় থেকে বঞ্চিত থাকতো।

২. এ রাত যদি সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত করে দেয়া হতো, তা হলে এ রাতের যথাযথ মর্যাদা দানে ব্যর্থ ব্যক্তিদের জন্য আল্লাহ'র আযাব অবধারিত হয়ে পড়তো।

৩. এ রাত অনির্দিষ্ট রাখার অন্যতম হিকমাত হলো, লাইলাতুল কদর খুঁজতে গিয়ে বান্দা যেন এ মাহে রমাযানে একটু বেশি বেশি নেক আমালে মশগুল হতে পারে।

তবে লাইলাতুল কদর অনির্দিষ্ট হলেও আমাদের জন্য অনেকটাই নির্দিষ্ট। কেননা, লাইলাতুল কদর সাধারণত রমাযান মাসেই হয়ে থাকে। তা হলে বাকি এগারো মাস থেকে নির্দিষ্ট হয়ে গেল একমাস। এক মাসের মধ্যে আবার শেষ দশকেই হওয়া নির্দিষ্ট। তা হলে আরো সীমাবদ্ধ হয়ে গেল। এরপর এ দশ দিনের মধ্যে আবার বেজোড় রাত্রে হওয়া নির্দিষ্ট। তা হলে আমরা লাইলাতুল কদরকে অনেকটা নির্দিষ্টই বলতে পারি। একটু সদিচ্ছা থাকলেই আমরা সবাই লাইলাতুল কদর পাবো। ইনশাআল্লাহ!

লাইলাতুল কদরে পড়ার দু'আ

রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন:

تَحَرُّوا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ مِنْ رَمْضَانَ البخاري، الصوم / تحرى ليلة القدر ۲۷۰/۱ رقم: ۲۰۱۷)

"তোমরা রমাযানের শেষ দশকে বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদর তালাশ কর।"

মা আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা যদি লাইলাতুল কদর পাই তা হলে কী করবো? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সা. বললেন:

قُولِي اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي (سنن الترمذي، الدعوات / رقم الباب ٨٥, ١٩١/٢ رقم (٣٥١٣)

হে আল্লাহ! তুমি পরম ক্ষমাশীল, ক্ষমা করাকে তুমি পছন্দ কর, কাজেই তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।"

লাইলাতুল কদরের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো গুনাহ মাফ হওয়া। রাসূলে কারীম সা. ইরশাদ করেন:

مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيْمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ

(البخاري، الصوم من صام رمضان ايمانا واحتسابا ٢٥٥/١, رقم: ١٩٠١)

“যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে আল্লাহ'র উপর বিশ্বাস রেখে পুণ্যের আশায় ইবাদত করে, তার পূর্বের কৃত সমস্ত পাপ মাফ করে দেয়া হয়।” আর লাইলাতুল কদরকে এ কারণেই লাইলাতুল কদর করে নামকরণ করা হয়েছে যে, আমল না করার কারণে ইতোপূর্বে যার কোন মান-সম্মান ছিল না সেও এ রাতে ইবাদত-বন্দেগী, তাওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে সম্মানিত হয়ে যায়।

No comments

Powered by Blogger.