Header Ads

Header ADS

এক অভাগা দুঃখী পরিবার

 

এক অভাগা দুঃখী পরিবার


চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে বাড়িতে রেখে প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছিল আতিক। একটুখানি সুখের আশায়। যেন বউ, বাচ্চা, বাবা আর মা ডাল ভাত খেয়ে সুখে দিনাতিপাত করতে পারে। কেউ যেন বেকার বলতে না পারে।
তার ঠিক ছয় মাস পরে সন্তান ভূমিষ্ট হলো। সবাই যখন নবজাতককে কোলে নেওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি তে ব্যস্ত তখন সে প্রবাস থেকেই ভিডিও কলে নিজের চোখের তৃপ্তি মিটিয়েছে। বাবা হওয়ার ভিন্ন স্বাদ আর অনুভূতি অনুভব করেছে দূর থেকেই। ছোট ছোট হাত পা একটুখানি মুখ আর পুতুলের মতো শরীরটাকে তারও ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছিল।
ইচ্ছে করছিলো, নরম সেই শরীরটাকে বুকে লুকিয়ে রাখতে। সাথে আরো ইচ্ছে করছিল বউয়ের কপালে উষ্ম স্পর্শ দিয়ে বলতে, ‘ধন্যবাদ বউ, আমাকে একটা তুলতুলে পুতুল উপহার দেওয়ার জন্য।’ তবে সেটা বলা হয়ে উঠেনি। দূর থেকে বলবে না। বউকে সে এই সামান্য কথা সরাসরি বলতে চায়।
.
দেড় বছরে পা দিল মেয়ে। তবে আজও আতিকের ভাগ্য হয়নি মেয়েকে ছুঁয়ে দেখার। মন আর চোখ যেন দিনকে দিন চাতক পাখির মতো তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠছে। সারাদিনের পরিশ্রম শেষে ভিডিও কলে মেয়েকে দেখে আর তার মুখের আধো আধো বুলিতে 'বাব্বা...হ্' ডাকটা শুনে তখন সারাদিনের ক্লান্তি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কলিজাটা কেমন শীতল হয় তার। আজকাল তো মোবাইলের মাঝেই হাত বাড়ায় বাবাকে ছুঁয়ার জন্য। মোবাইলের ভিতর থেকে বাবাকে বের করতে চায়। যতবার মেয়ে বাবা ডাকে ততবারই তার মনে হয় বাবা ডাকে এতো সুখ? তার বাবারও নিশ্চয়ই এমন সুখ লাগে যখন সে ডাকে? শায়লা যখন মেয়েকে বলে,
- 'কুহু বাবাকে তোমার দাঁত দেখিয়ে দাও তো।'
কুহু তখন অধর যুগল ফাঁক করে 'ইইই' করে বাবাকে সদ্য গজানো দাঁত দেখায় আর হাসে। আতিক তখন তার মেয়ের ফোকলা দাঁতের হাসি দেখে। বড্ড নিষ্পাপ সেই হাসি। আজ সেও একটা কন্যা সন্তানের বাবা। কথা ভাবতেই বুকে কেমন প্রশান্তির ঢেউ খেলে।
.
রাতের খাবার পর্ব শেষ করে বউকে কল দিল সে। তখন বাংলাদেশে আনুমানিক রাত বারোটা বাজে। দু'বার রিং হওয়ার পর মোবাইল রিসিভ করে শায়লা। মেয়ের দিকে মোবাইলের ক্যামেরা তাক করা। প্রায় দশ মিনিট মেয়েকে দেখার পর আতিক বললো,
- 'মেয়েকে তো দেখলাম। মেয়ের মা কি একটু ক্যামেরার সামনে আসবে? মেয়ের মাকে দেখার জন্য মনটা আকুপাকু করছে।'
শায়লা সেভাবেই মোবাইল ধরে রাখল। কোনো হেলদোল হলো না তার।
- 'আর কত অভিমান করে থাকবে বলো তো। দূরেই তো আছি। অভিমান করে যে আরো দূরে ঠেলে দিচ্ছ।'
তৎক্ষনাৎ নিজের দিকে ক্যামেরা ঘুরায় শায়লা। চোখে অভিমানের অশ্রু টলমল করছে।
- 'হায় হায় এতো বড় মেয়ে কাঁদে কেন?'
- 'রঙে কাঁদে।'
- 'কেঁদে কেটে এখনই সব উগ্রে ফেললে চলবে? আমি দেখার জন্যও কিছু রাখো। নাহলে তো পরে বলবো বউয়ের অনুভূতি ম'রে গেছে।'
- 'আপনি বিদেশই থাকেন দেশে আসা লাগবে না। টাকাই কামাই করে যান। বউ আর বাচ্চা দিয়ে কি করবেন?'
- 'দেখি তোমার কপালটা ক্যামেরার সামনে আনো তো হালকা করে একটা চুমু দেই।'
- 'আপনি ভালো হবেন না তাই না।'
- 'ভালো হলে কি মেয়ের বাপ হতে পারতাম বলো?'
_________
গত হয়েছে দুইদিন। পড়ন্ত বিকেল!
শায়লা মেয়ের দুই হাত ধরে হাঁটা শিখাচ্ছে। ঠিক তখনই গেটের বাইরে থেকে কেউ কড়া নাড়ে।
শায়লা গোমটা টেনে গেট খুলে দেখে আতিকের বন্ধু শাকিল।
- 'এইদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম ভাবি। ভাবলাম কুহুকে একটু দেখে যাই। একটু পানি খাওয়ান না। তৃষ্ণা পেয়েছে খুব।'
কুহুকে শাকিলের কাছে দিয়ে শায়লা পানি আনতে গেল। কুহু যখন শাকিলের শার্টের বোতাম নিয়ে খেলতে ব্যস্ত ঠিক তখন তার সামনে আরো একজন এসে দাঁড়ায়। চোখে কালো চশমা আর মুখে মাস্ক। ওইটুকু কুহু তখন মানুষটাকে চিনার জন্য ব্যস্ত।
লোকটা প্রথমে নিজের চোখে চশমা খুললো। তারপর খুললো মাস্ক খুলতেই ছোট্ট কুহুর চোখ দুটো চকচক করে উঠে খুশিতে। 'বাব্...বাহ্' বলে সে লাফিয়ে পড়ল আতিকের কোলে। কতক্ষণ চোখ স্পর্শ করছে তো কতক্ষণ নাক স্পর্শ করছে। খানিক বাদে লেপটে রইল বাবার বুকের সাথে। আবার মাথা উঁচিয়ে দেখতে লাগল বাবাকে। আবারও লেপটে গেল বুকের সাথে।
মেয়ের পাগলামো দেখে মুচকি মুচকি হাসছে আতিক। মেয়েকে বুকে নিতেই বুক কেমন শীতলতায় ছেয়ে গেল। অজানা এক সুখে এসে ঘিরে ধরল চারপাশে। আচ্ছা এটাই কি সন্তান সুখ? হয়তোবা।
- 'দুস্ত, আজ যদি এখানে উপস্থিত না হতাম তাহলে হয়তো এতো সুন্দর দৃশ্য কখনোই দেখতে পেতাম না। বলতে বাঁধ্য হচ্ছি মেয়েরা বাবা ভক্ত হয়। আর আজ বুঝলাম বাবারা কেন মেয়েকে এতো ভালোবাসে। তোকে কখনো দেখিনি সরাসরি অথচ দেখ কতটা নিশ্চিন্তে তোর বুকের সাথে মিশে রয়েছ।
মেয়েরা সবচেয়ে বেশি নিরাপদ হয়তো বাবার ছায়ায় থাকে। হয়তো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দেয় সকল প্রতিকূলতা থেকে রক্ষা করার জন্য মাথার উপর বাবা আছে। তোর অবুঝ মেয়েটাকে কেমন তোর উপস্থিতি উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। হয়তো একেই র'ক্তের টান বলে।'
- 'সেজন্যই তো বলি বিয়ে করে নে। বউয়ের কথা বাদ দিলাম। একজন সঙ্গীর কখনো তুলনা হয় না। বাবা নামক এক অদ্ভুত অনুভূতির সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য হলেও বিয়ে করা উচিৎ।'
গ্লাস পড়ে যাওয়ার শব্দে ঘাড় কাত করে তাকায় আতিক। স্ত্রীর চমকে যাওয়া মুখ আর বিস্ময়ের রেখা ফুটে উঠা চক্ষু জোড়া দেখে বিস্তৃত হাসলো সে। শায়লার কণ্ঠস্বর কাঁপছে। চোখের সামনে অপ্রত্যাশিতভাবে স্বামীকে দেখে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে গেলো। জোরে জোরে শ্বাশুড়িকে ডাকতে লাগল।
- 'মা, ও মা কই আপনি? দেখে যান কে এসেছে।'
ছেলের বউয়ের এমন আতঙ্কগ্রস্থ স্বর শুনে দৌড়ে বাইরে এলো আতিকের মা। চৌকাঠ থেকে বাড়ির উঠোনে ছেলেকে দেখে একেবারে স্থির হয়ে গেলেন তিনি। যেন কোনো স্বপ্ন দেখছেন। বহুদিন পরে ছেলেকে চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে আনন্দের অশ্রু।
.
মেয়েকে বুকে জড়িয়ে মায়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল আতিক। কুহু তখনও বাবার বুকের সাথে লেপ্টে রয়েছে। আতিকের মা তার সারা মুখে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আতিকের মাথায় হাত রেখে কাঁদছেন তিনি।
- 'তুমি আইছো বাপ? বুড়া মার কথা তোমার মনে পড়ছে? আর তোমার বিদেশ যাওয়া লাগবো না বাপ। তুমি আমার চোখের সামনে থাকো।'
আতিক মায়ের কপালে চুমু দিয়ে আরেক হাতে আগলে নিলো। মা এবং মেয়েকে বুকে জড়িয়ে এতোদিনের অপেক্ষায় থাকা স্ত্রীর দিকে তাকাল। শায়লা যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না মানুষটা তার চোখের সামনে। শায়লার চোখের দিকে তাকিয়ে আচমকাই চোখ টিপ দিল সে।
________________
বিকেল থেকে রাত অব্দি আতিকের কোল থেকে কেউ কুহুকে নিতে পারেনি। ওয়াশরুমে থেকে কোনোরকম গোসল করে বের হয়েছে। মেয়ে তার ওই সময়টা চিৎকার করে পুরো বাড়িয়ে মাথায় তুলেছে। সেই যে বুকের সাথে মিশে রয়েছে এখনো বুকেই আছে।
বাবার বুকের সাথে লেপ্টে ঘুমে বিভোর কুহু। শায়লা সবকিছু গুছিয়ে রুমে এলো। কুহুর জন্য বিছানা করে তাকে শুইয়ে দিল তাকে। আতিক দরজা বন্ধ করে শায়লাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। শায়লাও চুপটি করে স্বামীর বুকে মাথা রেখে ধুকপুক শুনতে লাগল। কতদিন পর এই মানুষটার স্পর্শ পেলো সে। দিনগুলো গুনা হয়নি। বহুদিন পরে আবারও এই মানুষ ভালোবাসায় রাঙাবে সর্বাঙ্গ।
- 'অভিমান কমেছে?'
- 'মাত্র কমলো।'
- 'আলিঙ্গন দেরিতে হওয়ায় রেগে আছো বুঝি?'
- 'উহ্! মোটেও না। সবুরে মেওয়া ফলে। এই যে সারারাতটা এখন আপনার আর আমার। স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা কাউকে দেখাইতে নেই। স্বামী স্ত্রী প্রণয়টা সুপ্ত থাকাই শ্রেয়। নাহলে বদনজর লেগে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। তার থেকে ভালো চার দেওয়ালের মাঝেই বন্ধি থাকুক। যেন কারো নজর না লাগে।
এবার মনে হয় আর বিদেশ পাড়ি দিতে পারবেন না। মেয়ে একদিনেই যা শুরু করছে। অথচ এতোদিন যত্ন করলাম আমি এমন পাগলামি কখনো করে নাই। মা হয়েও অবহেলিত আমি।'
- 'ধন্যবাদ তখন একটা বেকার ছেলেকে বিয়ে করে তার জীবন সঙ্গিনী হওয়ার জন্য। তাকে পুতুলের ন্যায় একটা রাজকন্যা উপহার দেওয়ার জন্য। ভালোবাসি বউ, তাই তো অভিমান করেছে বলে ছুটে এসেছি দূর প্রবাস থেকে।'
(সমাপ্ত)...

মূল্যবান মন্তব্য জানাতে ভুলবেন না।🥰

No comments

Powered by Blogger.