হাদীস শরীফ থেকে জানা যায়, আল্লাহ তা'আলা আসমানে 'শাজারাতুল ইয়াক্বীন' নামে চারটি কাণ্ড বিশিষ্ট একটি সুন্দর বৃক্ষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তা'আলার স্বীয় পবিত্র নূর হতে রাসূলুল্লাহ (ছঃ) এর নূর সৃষ্টি করে তা বহু সংখ্যক সাদা মুক্তা দিয়ে অতি সাবধানতার সাথে জড়িয়ে রেখে ময়ূর পাখীর মত আকৃতি দান করে বহু শত বছর সেই বৃক্ষের উপর বসিয়ে রাখেন।
• পাখীটি সেই বৃক্ষে সত্তর হাজার বছর পর্যন্ত আল্লাহর গুণ-কীর্তন, তাসবীহ-তাহলীল, ইবাদত-বন্দেগীতে নিমগ্ন থাকেন। অনন্তর আল্লাহ তা'আলা অতি মনোরম একটি আয়না তৈরী করে ময়ূর পাখীটির সামনে ধরেন। পাখীটি আয়নায় স্বীয় সৌন্দর্য ও শরীরের সুঠাম গঠন আকৃতি দেখে আল্লাহ তা'আলার সম্মুখে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ পাঁচটি সেজদা করেন। পরবর্তীতে সে সেজদার কারণেই আল্লাহ তা'আলা রাসূলুল্লাহ (ছঃ) কে ইহজগতে মানবজাতির জন্য রহমতরূপে প্রেরণ করার পর তাঁর উম্মতের উপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করে দেন।
এর কিছুকাল পরে উক্ত নূরে মুহাম্মদীর প্রতি আল্লাহ তা'আলা মহব্বতের দৃষ্টিতে তাকান। এতে পাখীরূপ 'নূরে মুহাম্মদী' লজ্জায় জড়সড় হন এবং তাঁর সমস্ত শরীর ঘর্মাক্ত হতে থাকে। এই মহব্বতের দৃষ্টির ফলে নূরে মুহাম্মদী হতে যে ঘাম বের হয়, তা হতেই আল্লাহ তা'আলা আঠারো হাজার মাখলুকাত সৃজন করেন। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (ছঃ) এর এক নাম 'উম্মী' হয়েছে। আরবী ভাষায় 'উন্মুন' শব্দের অর্থ হল মূল। যেহেতু সৃষ্ট জীব রাসূলুল্লাহ (ছঃ) এর নূর হতে সৃষ্টি, সুতরাং তিনিই সকল সৃষ্টির মূল।'
( অতঃপর পাখীরূপ নুরে মুহাম্মদী শত শত বছর অবস্থান করে আল্লাহ তা'আলার গুণ-কীর্তন, তাসবীহ-তাহলীল ও ইবাদত-বন্দেগীতে নিমগ্ন থাকেন। এরপর আল্লাহ তা'আলা নূরে মুহাম্মদী হতে সকল নবী-রাসূলদের আত্মাসমূহ সৃজন করেন এবং সেসকল আত্মাকে কালেমা ত্বাইয়েবা-
لا إِلَهَ إِلَّا اللَّه مُحَمَّدٌ رَّسُولُ اللَّهِ
লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ
('আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মদ (ছঃ) তাঁর রাসূল) পড়ার নির্দেশ দেন।
আল্লাহ তা'আলার নির্দেশে সকল নবী-রাসূলের আত্মা উক্ত কালেমা পাঠ করতঃ হযরত মুহাম্মদ (ছঃ)কে নবী বলে স্বীকার করে নিলেন। এ কারণেই তাঁকে সাইয়েদুল মোরসালীন বা নবীদের নেতা বলা হয়।
• এটা দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায়, রাসূলে করীম (ছঃ) শুধু 'খাতেমুল আম্বিয়া' বা সর্বশেষ নবীই নন এবং তিনি 'ফাতেহুল আম্বিয়া' বা সর্বপ্রথম নবীও। কারণ আল্লাহ তা'আলা সর্বপ্রথম নবী করীম (ছঃ) এর নূরকেই সৃষ্টি করেছেন এবং সেই নূর হতেই সকল কিছুর সৃষ্টি। এ সম্পর্কে আল্লাহর রাসূলের উক্তি:
'আল্লাহ্ সর্বপ্রথম আমার নূরকেই সৃষ্টি করেছেন'।
একই কারণে তাঁকে প্রথম সৃষ্টিও বলা হয়।
• এর কিছু কাল পর পুনরায় আল্লাহ তা'আলা অত্যাশ্চর্য সুন্দর একটি কিন্দীল (ঝাড়বাতি) নির্মাণ করে তার মধ্যে রাসূলে করীম (ছঃ) এর আকৃতি সৃষ্টি করে অতি সতর্কতার সাথে সংরক্ষণ করেন।
রাসূলে করীম (ছঃ) এর উক্ত সংরক্ষিত আত্মার চতুষ্পার্শে সকল মানবাত্মা ঘুরে ঘুরে শত শত বছর পর্যন্ত আল্লাহ তা'আলার তাসবীহ-তাহলীল, ইবাদত-বন্দেগী করছিল। এমন সময় আল্লাহ তা'আলা সকল আত্মাকে নির্দেশ দিলেন-'হে রূহ সকল! তোমরা সকলে আমার প্রিয় বান্দা মুহাম্মদ (ছঃ)এর নূরের দিকে একবার দৃষ্টি দিয়ে দেখ।' সকল মানবাত্মা নূরে মুহাম্মদীর দিকে একবার দৃষ্টি দিল। এর ফলে যে আত্মাসমূহ সর্বপ্রথম রাসূলে করীম (ছঃ) এর মস্তক অবলোকন করেছে, তারা দুনিয়ায় খলিফা ও বাদশাহ হয়েছে।
• আর যারা কপাল প্রত্যক্ষ করেছে, তারা নিঃস্বার্থ জননেতা হতে পেরেছে, যারা রাসূলুল্লাহ (ছঃ) এর ভ্রূ প্রত্যক্ষ করেছে, তারা হয়েছে নাক্কাশ তথা শিল্পী। আর যারা কর্ণদ্বয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে পেরেছে, তারা হয়েছে ভাগ্যবান ও ধন-দৌলতের অধিকারী, যরা চক্ষুদ্বয় দেখেছে তারা হয়েছে কোরআনে হাফেজ।
• আর যারা রাসূলে করীম (ছঃ) এর গালদ্বয় দেখতে পেয়েছে, তারা দুনিয়াতে জ্ঞানী ও দানশীল হয়েছে। যাদের দৃষ্টি রাসূলে করীম (ছঃ) এর নাকের উপর পড়েছে, তারা হেকিম ও সুগন্ধি বিক্রেতা হয়েছে।
আর যারা ঠোঁট ও দন্ত মাড়ি প্রত্যক্ষ করেছে, তারা দুনিয়ায় শান্ত-শিষ্ট ও দানশীল হয়েছে, যারা রাসূলে করীম (ছঃ) এর মুখ প্রত্যক্ষ করেছে, তারা অত্যন্ত রোযাব্রতকারী হতে পেরেছে।
আর যারা জিহ্বা অবলোকন করেছে, তারা পৃথিবীর রাজা-বাদশাহদের দূত হতে পেরেছে। অনুরূপভাবে যারা রাসূলে করীম (ছঃ) এর গলদেশ অবলোকন করেছে, তারা বিখ্যাত উপদেশ প্রদানকারী ও মোয়াজ্জিন হয়েছে।
যারা রাসূলে করীম (ছঃ) এর দাড়ি মোবারক প্রত্যক্ষ করেছে, তারা দুনিয়ার খ্যাতিমান যোদ্ধা হয়েছে, যারা ঘাড় অবলোকন করেছে, তারা ব্যবসায়ী হয়েছে।
যারা উভয় বাহু অবলোকন করেছে, তারা দুনিয়ায় তরবারি ও তীর বর্ষণে পারদর্শী হয়েছে। যারা শুধু দক্ষিণ বাহু প্রত্যক্ষ করেছে, তারা হাজ্জাম তথা নাপিত হয়েছে এবং যারা শুধু বাহু প্রত্যক্ষ করেছে, তারা দুনিয়ার বাদশাহদের জল্লাদ (হত্যাকারী) হয়েছে।
অনুরূপ, যারা ডান হাতের তালু প্রত্যক্ষ করেছে, তারা মহাজন হয়েছে এবং যারা বাম হাতের তালুর প্রতি দৃষ্টি দিয়েছে, তারা দুনিয়ার জিনিস ওজন করার কার্যে পারদর্শী হয়েছে।
যারা উভয় হাতের তালু প্রত্যক্ষ করেছে, তারা দানশীল এবং মাল-দৌলত উপার্জনকারী হয়েছে। যারা উভয় হাতের পৃষ্ঠ দেখেছে, তারা হয়েছে অত্যন্ত কৃপণ। আর যারা রাসূলে করীম (ছঃ)এর ডান হাতের আঙ্গুল দেখেছে, তারা লেখক এবং যারা বাম হাতের আঙ্গুল অবলোকন করেছে তারা হয়েছে দরজী।
যারা রাসূলে করীম (ছঃ) এর বক্ষ মোবারক অবলোকন করেছে, তারা প্রকৃত আলেম ও শরীয়াতের মুজতাহেদ হতে পেরেছে। যারা রাসূলে করীম (ছঃ) এর পৃষ্ঠ দেশের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে পেরেছে, তারা অত্যন্ত কোমল প্রাণ ও ধর্মানুরাগী হতে পেরেছে।
অনুরূপভাবে যারা রাসূলে করীম (ছঃ) এর পার্শ্বদেশ অবলোকন করেছে, তারা হয়েছে গাজী বা ধর্মযুদ্ধে বিজয়ী। যারা রাসূলে করীম (ছঃ) এর পেট প্রত্যক্ষ করেছে তারা কমলোভী এবং পরহেজগার বা সংযমী হয়েছে।
যারা রাসূলে করীম (ছঃ) এর হাঁটু মোবারক দেখতে সমর্থ হয়েছে, তারা দুনিয়ায় বিনীতভাবে রুকু-সেজদা করতে শিখেছে। যারা পদদ্বয় দর্শন করেছে, তারা দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে শিকার কার্যে দক্ষতা অর্জন করেছে। অনুরূপ যারা পদদ্বয়ের নিম্নদেশ দর্শন করেছে, তারা অত্যন্ত ভ্রমণকারী হয়েছে।
যাদের আত্মা ভাগ্যের বিপর্যয় হেতু রাসূলে করীম (ছঃ) এর পবিত্র নূরানী দেহের কোন অংশই প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পায়নি, তারা হয়েছে-ইয়াহুদী, খ্রিস্টান, কাফের এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (ছঃ) এর শত্রু দলের অন্তর্ভুক্ত।
মোটকথা, মানবজাতির ভাল-মন্দ, উন্নতি-অবনতি, জান্নাত-জাহান্নাম সকলই একমাত্র রাসূলে করীম (ছঃ) এর উছিলায় সংঘটিত হয়েছে এবং হবে।
তথ্যসূত্র: মরণের আগে ও পরে (ইমাম গাযালী র.)
No comments:
Post a Comment