হযরত ইবরাহীম (আ)-এর জন্ম কাহিনী:
📖 হযরত ইব্রাহিম আ: এর জীবনী: (১নং পর্ব)
তৌরাতে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর যে বংশ পরিচয় বর্ণিত রয়েছে তা হল ইবরাহীম (আ)-এর পিতা তারেখ তাঁর পিতা নাহুর তাঁর পিতা সরুজ তাঁর পিতা রাউ তাঁর পিতা ফালে তাঁর পিতা আবের তাঁর পিতা সালেহ তাঁর পিতা এরফেক তাঁর পিতা সামের তাঁর পিতা নূহ্ (আ)। এ হিসাবে হযরত ইবরাহীম (আ) সাম বিন নূহের বংশের অধঃস্তন দুশম ব্যক্তি। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) হতে এক রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর পিতার নাম তারেখ এবং তার মাতার নাম শানী। কিন্তু পবিত্র কোরআনে তাঁর পিতার নাম আযর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন-
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ لِأَبِيهِ أَذر أَتَتَّخِذُ أَصْنَانًا آلِهَةً -
উচ্চারণ : অ ইয ক্বা-লা ইব্রাহীমু লি আবীহি আ-যারা আতাত্তাখিযু আছ না-মান আ-লিহাহ।
অর্থ: যখন ইবরাহীম তার পিতা আযরকে বলেছিল আপনি কি প্রতিমাসমূহকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করেছেন?
⏩ হযরত ইবরাহীম (আ)-এর জন্ম কাহিনী:
যখন আরব অনারব কোথাও সাম তাঁর পিতা নূহ (আ)-এর বংশধরদের কেউই অবশিষ্ট ছিল না, তাদের বংশধরদের অনেকে তুফানে এবং অনেকে ফেরেশতাদের বিকট শব্দে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। তখন অনারব এলাকা থেকে অভিশপ্ত নমরূদের উত্থান ঘটে। নমরূদের ভাষা ছিল আরবী। অনেকে আবার নমরূদের বংশসূত্র এরূপ বর্ণনা করেছেন- কায়কাউস তার পিতা কায়কোবাদ তার পিতা মুনচেহের তার পিতা ফরীদুন তার পিতা আমশেদ, তবে নমরূদের এ বংশ নামা সঠিক নয়। সঠিক অভিমত হচ্ছে- তার নাম নমরূদ। সে ছিল অত্যন্ত প্রভাব-প্রতিপত্তিসম্পন্ন ও শান শওকতের অধিকারী। সে এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে শাম দেশ দখল করে। অতঃপর তুর্কিস্তান জয় করে ইয়াফেস ইবনে নুহের বংশধরদের স্বীয় অধীনস্থ করে। তুর্কিস্তানের পর সে ভারত আক্রমণ করে সেখানে বসাবাসরত নূহ (আ)-এর বংশধরদেরকে তার অধীনতা স্বীকারে বাধ্য করে। অতঃপর সে রোমও দখল করে। তৎকালীন পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত সমগ্র এলাকা সে দখল করে। এরপর সে বাবেলে বসবাস করতে থাকে। এ স্থানকেই কুফা বলা হয়।
ভারত, তুর্কিস্তান, রোমসহ পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের সমগ্র এলাকা থেকে তার জন্য কর, খাজনা, উপহারাদি আসত। এহেন প্রভাব-প্রতিপত্তি, ও শান শওকতের সাথে সে এক হাজার সাতশ' বছর পর্যন্ত রাজত্ব করে। সে নিতান্তই দাম্ভিক স্বভাবের ছিল। সে কখনো আকাশের দিকে তাকাত না। সে আল্লাহর নিকট কখনও নিজের কোন প্রয়োজন পূরণের প্রার্থনা করত না। সে বলত আমি নিজেই খোদা। আকাশের খোদা আবার কে! যখন সে শকুনের ডানায় চড়ে আল্লাহকে তীর নিক্ষেপের উদ্দেশ্যে উর্ধ্বারোহণ করছিল, কেবল তখনই আসমানের - প্রতি চোখ তুলে তাকিয়েছিল। আকাশের দিকে শকুনের পিঠে চড়ে যেতে যেতে সে বলছিল, যদি আকাশে কোন খোদা থেকে থাকে, তবে এ তীর নিক্ষেপে তাকে হত্যা করব। নমরূদ বাইরে কোথাও বের হলে নিজের সিংহাসনের চার পায়া চারটি হাতীর পৃষ্ঠের ওপর রেখে তাতে উপবেশন করত। তার সিংহাসনের পায়া রোমী রেশম দিয়ে আবৃত করে, মূল্যবান মতি আর হীরা জহরত দিয়ে সুসজ্জিত করা হত। স্বর্ণ সূত্র দিয়ে তাঁবুর রশি বানানো হত। সে সিংহাসনে উপবেশন করলে সিংহাসনের নিচে চারশ' কুরসী পাতা থাকত। এসব কুরসীতে দরবারী, আমীর ওমরাহ জাদুকর, জ্যোতিষ ও নিরাপত্তা কর্মীরা বসত। কথিত আছে, সপ্ত একলীমের রাজত্ব মাত্র চার জন লাভ করেছিল। চার জনের সমান রাজত্ব আর কেউই লাভ করতে সক্ষম হয়নি। এ চার জনের দুজন ছিলেন মুসলমান আর দুজন ছিল কাফের। মুসলমান দু'জনের একজন হলেন হযরত সুলাইমান (আ) ও অপর জন হযরত যুলকারানাইন। আর কাফের দু'জনের একজন ছিল নমরূদ ইবনে কেনআন আর অপরজন ছিল বোখতে নসর। এ চার জনই কেবল পুরো সপ্ত একলীমের রাজত্ব লাভ করে। একদিন নমরূদ সিংহাসনে উপবিষ্ট। এ। সময় সে সৈন্য সামন্ত, আমীর ওমরাহ পরিবেষ্টিত ছিল, জাদুকর জ্যোতিষী সবাই মাথা নুইয়ে চিন্তাযুক্ত অবস্থায় বসে আছে। অভিশপ্ত নমরূদ তাদেরকে জিজ্ঞেস করল- আজ তোমাদের হয়েছে কি? তোমরা এমন মন ভাঙ্গা ও চিন্তাযুক্ত হয়ে বসে আছ কেন। তারা বলল- আপনার কল্যাণ হোক। আজ আসমানে এমন আজব এক নক্ষত্র দেখা গেছে যা আর কখনও আমরা দেখিনি। এ নক্ষত্রটি আজই পূর্বাকাশে উদিত হয়েছে। নমরূদ বলল, সে নক্ষত্র কেমন। তারা বলল, একটি ছেলে পিতার ট্যুরস থেকে মাতৃগর্ভে স্থান নেয়ার আগাম সংকেত এ নক্ষত্রটি আর ছেলেটি দ্বারাই আপনার রাজত্ব ধ্বংস হবে। নমরূদ বলল, সে কখন পিতার ঔরষ থেকে মাতৃগর্ভে আসবে? জ্যোতিষরা বলল, আজ হতে তিন দিন তিন রাতের মধ্যেই মাতৃগর্ভে তার আগমন ঘটবে। একথা শুনে নমরূদ নির্দেশ জারি করল- অদ্য হতে তিন দিন তিন রাত পর্যন্ত কোন স্ত্রীলোক তার স্বামীর শয্যাসঙ্গিনী হতে পারবে না।
• তারেখ নামে নমরূদের এক বিশ্বস্ত দেহরক্ষী ছিল। কোরআনে যার নাম আযর বলা হয়েছে। সে এক হাতে প্রদীপ আরেক হাতে তরবারি ধরে সারা রাত নমরূদের মাথার কাছে পাহারারত থাকত। এটাই তার সর্বদার কাজ। যেদিন নমরূদ স্ত্রীদের তার স্বামীর শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, আল্লাহর ইচ্ছায় সেদিনই তারেখের মনে স্ত্রীসঙ্গ লাভের আকাঙ্ক্ষা তিব্রতর হয়ে উঠে। একইভাবে তারেখের স্ত্রীর মানসিক অবস্থাও একই হয়। কি করে আজকে স্বামীসঙ্গ লাভ করে পরিতৃপ্ত হবে সে ভাবনাই মনে মনে সে ভাবতে লাগল। এ অবস্থায় অর্ধরাত কেটে যায়। তার স্বামী সঙ্গ লাভের কামনাও চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যায়। অগত্য সে চুপিসারে গৃহত্যাগ করে নমরূদের শাহী মহলের দরজায় উপনীত হয়। তারেখ পত্নী সেখানে পৌঁছে দেখল, দারোয়ান, সিপাই-সান্ত্রী সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাই সে নির্বিঘ্নে নমরূদের খাস শয্যা কক্ষে প্রবেশে সমর্থ হয়। সেখানে স্বামীকে দেখতে পেল এক হাতে প্রদীপ আর এক হাতে তলোয়ার নিয়ে নমরূদের মাথার কাছে দণ্ডায়মান। চাব চোখের মিলন হতেই তাদের জৈবিক তাড়না পূর্বাপেক্ষা প্রবল হয়। তারেখ স্ত্রীকে বলল, এখন কি পরামর্শ। আমার উভয় হাতই আটক। কি করা, এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রী ভাবনারত। এমন সময় আল্লাহর ইচ্ছায় এক পরীর আগমন ঘটে। সে তারেখের হস্তস্থিত প্রদীপ আর তরবারি স্বহস্তে ধারণ করে নমরূদের শিয়রে তারেখের মতই দাঁড়িয়ে যায়। এ সুযোগে স্বামী-স্ত্রী নমরূদের শিয়রের পাশেই রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। এ রাতেই মহান আল্লাহর অপার মহিমায় হযরত ইবরাহীম (আ) পিতৃ ঔরস থেকে মাতৃগর্ভে আসেন। তারেখ স্বীয় পত্নীকে বলল, সাবধান। এ রহস্য যেন কেউ কখনও উদঘাটন করতে না পারে। এখান থেকে বের হয়ে অত্যন্ত সন্তর্পনে বাড়িতে পৌছুবে। পথে যেন কারো দৃষ্টিতে না পড়। এটা একটা লজ্জারও ব্যাপার। তারেখের স্ত্রী নমরূদের রাজ মহল থেকে বের হয়ে অতি সতর্কতার সাথে গৃহে প্রত্যাবর্তন করল। একমাত্র আল্লাহই তাদের এ সংগোপনে মিলন ও গমনাগমন সম্পর্কে জানতেন। ভোরে ঘুম থেকে উঠে তারেখের প্রতি নমরূদের দৃষ্টি পড়তেই সে তার চেহারায় নূর চমকাতে দেখল। সে বলল, কি ব্যাপার তারেখ, অদ্য তোমার মুখ মণ্ডলে অন্য দিনের চেয়েও নুরানী দেখতে পাচ্ছি যে! তারেখ ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ার জন্য আশীর্বাদ করতে নিবেদন করল। সেখান থেকে নমরূদ সিংহাসনে আরোহন করে পাদ্রী, গণক ঠাকুর ও জ্যোতিষদেরকে ডেকে বলল, এখন বল তোমাদের কথিত ছেলেটি মাতৃগর্ভে এসেছে কিনা! সবাই গনে পড়ে সমস্বরে বলে উঠল, জাহাপনা। কথিত ছেলেটি গত বাতে প্রিত ঔরস থেকে মাতৃগর্ভে অবস্থান নিয়েছে।
এবার অভিশপ্ত নমরূদ নির্দেশ জারি করল যত রমনী অন্তঃসত্ত্বা, তারা সবাই যেন প্রসেবের পর আপন আপন পুত্র সন্তানকে হত্যা করে ফেলে। এ নির্দেশ নামা পেয়ে সব গর্ভবতী নারী প্রসবের পর নিজ নিজ পুত্র সন্তান হত্যা করে ফেলে। যখন মাতৃগর্ভে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর নয় মাস কেটে যায়, তখন তাঁর মা নমরূদের ভয় এবং সন্তানের মহব্বতে অতি গোপনে ঘর থেকে বের হয়ে শহরের বাইরে ময়দানে এক গর্তে অবস্থান নেয়। এ গর্তেই হযরত ইবরাহীম (আ) ভূমিষ্ট হন। তিনি ভূমিষ্ট হওয়ার পর তাঁর নূরে গোটা গর্ত আলোকিত হয়ে পড়ে। এসময় ইবরাহীম (আ)-এর মা কাঁদতে লাগলেন- ফেউ এ গর্তে এসে তার প্রাণপ্রিয় সন্তানকে হত্যা করে না ফেলে। অগ্যতা ছেলেকে একখানা বস্ত্রে আবৃত করে গর্তে রেখেই ঘরে ফিরে আসেন। তৎক্ষণাত হযরত জিবরাঈল (আ) অবতরণ করে নবজাতকের দু হাতের দুটি আঙ্গুল তার মুখে পুরে দেন। আল্লাহর অসীম কুদরতে মুখে পুরে দেয়। নবজাতকের আঙ্গুল দুটির একটি থেকে দুধ এবং অন্যটি থেকে মুধ নির্গত হতে শুরু করে। ইবরাহীম (আ) এ দুধ-মধু পান করেই পরিতৃপ্ত হতেন। আর কিছুর অভাব বোধ করতেন না। প্রতি সপ্তাহেই ইবরাহীম (আ)-এর মাতা একবার গর্তে যেতেন এবং পুত্রের লালিত পালিত হবার অবস্থা দেখে বিস্মিত হয়ে তথা হতে ঘরে ফিরে আসতেন। মা যখন চলে আসত অদৃশ্য থেকে একটি পাথর এসে গর্তের মুখ বন্ধ করে দিত। এভাবে সাত বছর গত হয়। হযরত ইবরাহীম (আ) অন্ধকার গর্তেই আল্লাহর অসীম কুদরতে লালিত পালিত হয়ে থাকেন।
একদিন হযরত ইবরাহীম (আ) মাকে জিজ্ঞেস করলেন ওগো মা' আমার আপনার স্রষ্টা, পালনকর্তা কে? মা বললেন, আমার খোদা তো তোমার পিতা। সে আমাকে আহার ও পরিধেয় বস্ত্র দেয়। ইবরাহীম (আ) এবার জিজ্ঞেস করলেন, তার খোদা কে? মা বললেন, তার খোদা হচ্ছে তারকারাজী। এবার তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তাদের স্রষ্টা ও পালনকর্তা কে? এ জবাবে মা নিরুত্তর এবং লজ্জিত হয়ে সেখান থেকে চলে আসেন। গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর স্বামী তারেখের নিকট এসব কথোপকথনের অর্থ ব্যক্ত করেন। বৃত্তান্ত শুনে তারেখ বলল, নিঃসন্দেহে এ ছেলে বাদশাহ নমরূদের শত্রু হয়ে দাঁড়াবে। এ ব্যাপারে কি করা যায় তারেখ তাই ভাবছিল। এক রাতে ইবরাহীম (আ) গর্ত থেকে বাইরে এসে গগনের প্রতি দৃষ্টি দিতেই অগণিত নক্ষত্ররাজি দেখে বললেন, আমার পিতা মাতা এ নক্ষত্ররাজিকেই স্রষ্টাও পালনকর্তা বলেন। বর্ণিত ঘটনাই পবিত্র কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ ইরশাদ করেন-
উচ্চারণ : ফালাম্মা-জান্না আলাইহি ল্লাইলু রাআ-কাওকাবান কা-লা হা-যা-রব্বী: ফালামা-আফালা কা-লা লা-উহিব্বুল আ-ফিলীন।
অর্থঃ অতঃপর যখন রাতের আঁধার অবতীর্ণ হয় তখন তিনি একটি নক্ষত্র দেখে বললেন, এটিই আমার রব, যখন সেটি অদৃশ্য হয়ে গেল, তখন তিনি বললেন, অস্তায়মান সত্তার প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই।
অতঃপর যখন চন্দ্র উদিত হল তখন তিনি বললেন, এটিই আমার রব। কোরআনের বর্ণনা-
উচ্চারণ : ফালাম্মা-রাআল কামারা বা-যিগান কা-লা হা-যা-রব্বী, ফালামা-আফালা ক্বা-লা লায়িল্লাম ইয়াহদিনী রাব্বী লাআকুনান্না মিলাল কাওমিদ দোআ-ল্লীন।
অর্থঃ অতঃপর যখন দীপ্তিমান চন্দ্র দেখতে পেলেন তখন বললেন, এটিই আমার রব। সেটি অদৃশ্য হয়ে গেলে তিনি বললেন, আমার রব যদি আমাকে পথ প্রদর্শন না করেন তাহলে আমি পথ হারা-ই থেকে যাব।
অতঃপর যখন উজ্জল সূর্য দেখতে পেলেন, তখন বললেন, এটিই আমার রব এবং সবচেয়ে বড়। কোরআনের বর্ণনা।
উচ্চারণ: ফালাম্মা-রাআশ শাসা বা-যিগাতান ক্বা-লা হা-যা-রব্বী হা-যা-আকবার, ফালামা-আফালাত ত্বা-লা ইয়া-কাওমি ইন্নী বারিউম মিম্মা-তুশরিকুন। (ইন্নী ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়া লিল্লাযী ফাতোয়ারাস্ সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরদ্বোয়া হানিফাও ওয়ামা-আনা মিনাল মুশরিকীন।
অর্থঃ অতঃপর যখন তিনি উজ্জল সূর্য দেখলেন, তখন বললেন, এটি আমার রব, এটিই সর্ববৃহৎ। সূর্য যখন অস্ত গেল তখন বলেন, হে আমার জাতি! তোমরা যাদেরকে রবের শরীক করছ, আমি তা হতে মুক্ত পবিত্র। (আমি আমার চেহারা সে সত্তার প্রতি ফিরাচ্ছি যিনি আসমান জমিনের একক স্রষ্টা, আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।)
ইবরাহীম (আ) বাল্যকালেই দেখেছেন, তাঁর স্বগোত্রীয় লোকেরা আসমান যমীনের স্রষ্টাকে
আল্লাহ্ বা রব বলে না। নিজের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তাদের কেউ দেব মূর্তির, কেউ তারকারাজির, আবার কেউ বা চন্দ্র-সূর্যের উপাসনা করে। তিনিও কোন এক সত্তাকে রব সাব্যস্ত করতে মনস্থ করেন। দেব মূর্তিসমূহের প্রতি তো তিনি পূর্ব হতেই বিমুখ ছিলেন। অতএব একটি নক্ষত্রকে নিজের রব সাব্যস্ত করেন, কিন্তু নক্ষত্র যখন অদৃশ্য হয় তখন বুঝলেন, এটি সর্বদা এক অবস্থায় থাকে না। সুতরাং আরো কোন সত্তা রয়েছেন যিনি এদের পরিচালক। লুক্কায়িত নক্ষত্র যদি রবই হত তবে সেটি উন্নত অবস্থা হতে নিম্নাবস্থায় আসত না। তাই এটি রব হতে পরে না। অতঃপর যখন চন্দ্র-সূর্য দেখলেন তখনও উভয়কে রব ঠিক করে দেখতে পেলেন, উভয়ই অস্তায়মান। সুতরাং তিনি সিদ্ধান্তে পৌছুলেন যে অস্তায়মান সত্তা কখনও রব হতে পারে না। ফলে তিনি সব কিছু পরিত্যাগ করে এমন সত্তাকে রব হিসাবে গ্রহণ করেন যাঁকে সবাই মানে, স্বীকার করে। আর পরিপক্ক বিবেক বুদ্ধির দাবীও হচ্ছে এমন সত্তাকে রব হিসেবে গ্রহণ করা, যে সত্তা থেকে সকলেরই কার্যোদ্ধার হয় এবং যিনি সর্বোপরি শক্তিশালী, ক্ষমতাবান।
আযর হযরত ইবরাহীম (আ)-কে বলেছিল, হে বৎস! নমরূদ ব্যতীত আমাদের অন্য কোন খোদা নেই। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, ভূমণ্ডলও নভোমণ্ডলের স্রষ্টা রব এক একক লা শারীক সত্তা। এবার আযর ইবরাহীম (আ)-কে বলেন
উচ্চারণঃ ক্বা-লু আজি'তানা-বিলহাক্কি আম আনতা মিনাল 'লা-ই'বীনা।
অর্থঃ সে বলল, তুমি আামাদের কাছে সত্য কথাই এনেছ বটে, তুমি তো কৌতুককারীদের দলভুক্ত। আযরের উক্তির জবাবে ইবরাহীম (আ) বললেন-
উচ্চারণঃ ক্ব-লা বার রববুকুম রববুস সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরদ্বিল্লাযী ফাতোয়ারাহুন্না ওয়া আনা 'আলা-যা-লিকুম মিনাশ্ শা-হিদীন।
অর্থঃ ইবরাহীম বললেন- না, বরং আপনার রব তো তিনি যিনি আসমান-যমীনের স্রষ্টা, আর আমি এ বিশ্বাসের সাক্ষ্যদাতা।
তিনি আল্লাহর নামে শপথ করে বললেন, হে আমার পিতা। আমি আপনার ইলাহ প্রতিমাগুলোর একটি ব্যবস্থা করে তবেই ছাড়ব। তাঁর শপথের বর্ণনায় আল্লাহ্ তা'আলা ইরশাদ
করেন:
উচ্চারণঃ ওয়া তাল্লা-হি লাআকীদান্না আছনা-মাকুম বা'দা আন্ তুওয়ালু মুদবিরীন।
অর্থ: আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের প্রতিমাগুলো সম্পর্কে চিন্তা করব যখন তোমরা পশ্চাতে গমন করবে।
উক্ত শপথ ইবরাহীম (আ) মনে মনে করেছিলেন-অতঃপর সব লোক যখন শহরের বাইরে অনুষ্ঠিত মেলায় চলে গেল তখন তিনি প্রতিমালয়ে প্রবেশ করে সবগুলো মূর্তি ভেঙ্গে ফেলেন। এ ঘটনার বর্ণনায় আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন:
উচ্চারণ : ফাজ্বা'আলাহুম জুযাযান ইল্লা-কাবীরাল্লাহুম্ লা'আল্লাহুম ইযারজিউ'ন।
অর্থঃ অতঃপর ইবরাহীম (আ) সেগুলোকে ভেঙ্গে টুকরা টুকরা করে ফেলেন, কিন্তু বড় দেব মুর্তিটিকে আস্ত রেখে দেন এ আশায়, সম্ভবতঃ তারা ফিরে আসবে এবং তাদের পূজ্য দেব মূর্তিগুলোকে অপমান অপদস্থতার অবস্থায় দেখতে পাবে। ইবরাহীম (আ)-এর আশা ছিল, লোকেরা মেলা থেকে এসে তাদের পূজ্য দেব
মূর্তিগুলোকে এহন অপমাণিত অপদস্থ অবস্থায় দেখলে এগুলোর পূজা থেকে বিরত থাকবে। নমরূদের জাতির লোকেরা বছরে দু'দিন বেশ বড় ধরনের ও আনন্দ মুখর উৎসব পালন করত। এ মেলায় নমরূদের জাতির সুস্থ সবল সব লোকই অংশ গ্রহণ করত। আযর একদিন হযরত ইবরাহীম (আ)-কে বলল, হে বৎস! মেলা দেখতে আমাদের সাথে ময়দানে চল। তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। কোরআনের ভাষায়-
উচ্চারণ : ফানাযারা নাযরাতান ফিন নুজুমি ফা-ক্বা-লা ইন্নী সাকীম, ফাতাওয়াল্লাও 'আনহু মুদ্রবিরীন।
অর্থঃ তিনি এক বার তারকাসমূহের প্রতি তাকিয়ে অতঃপর বলেন, আমি রোগাক্রান্ত, অতএব তাদের থেকে বিমুখ হলেন।
(২নং পর্ব আসিতেছে ইনশাআল্লাহ)
No comments