এগারতম দফা
আল্লাহ পাক নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা যখন কোন জিনিস মাপ, তখন পূর্ণ করে মাপবে। আর ওযন করার সময় সমান দাড়িপাল্লা দিয়ে ওযন করবে। ওযনে কম দিলে একদিকে যেমন অপরকে ধোঁকা দেওয়া হয়, অপরদিকে এই উপার্জনটা সম্পূর্ণ হারাম হয়। হযরত শোআইব (আঃ)-এর কাউমকে আল্লাহ পাক এই অপরাধের জন্য ধ্বংস করেছেন যে, তারা মাপে কম দিত। যদি কেউ দাড়ি পাল্লার হেরফের করে ওযনে কম দেয়, নিরীহ মানুষকে ঠকায় এবং বিচারে পক্ষপাতিত্ব করে, তার পরিণতি হল দোযখ।
বারতম দফা
আল্লাহ পাক নির্দেশ দিচ্ছেন, তুমি যা জান না সেটার পেছনে লেগনা। কারো কাছে নতুন ধরনের খবর শুনলে সেটার তথ্য অনুসন্ধান না করে গুজবে কান দিওনা বা অজ্ঞাত বস্তুর সাক্ষী দিওনা। সঠিক সংবাদ অবগত হওয়া ছাড়া যা শুনেছ, তা জনগণের কাছে প্রচার করবে না। কেননা, তোমার শ্রবণ শক্তি, দৃষ্টি এবং ধারণ শক্তির জওয়াব দিতে হবে। গুজব ছড়ানো, মিথ্যা সাক্ষী, আন্দাযী ওয়াজ নসীহত এসব নিষেধ করা হয়েছে। সুতরাং এ বিষয়ে প্রত্যেকের সতর্ক থাকা দরকার।
তেরতম দফা
আল্লাহ পাক নির্দেশ দিচ্ছেন, তোমরা অহঙ্কার করবে না। অহঙ্কার পতনের মূল। তুমি আল্লাহর বান্দা হিসেবে অতি নগণ্য দুর্বল। দুনিয়ার সামান্য সময়ের জন্য ক্ষমতা পেয়ে বাহাদুরী দেখানো ও পদমর্যাদা এবং সম্পদের গৌরব দেখানো তোমাদের পক্ষে মোটেই শোভা পায় না। নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করতে হবে এবং বিনয় থাকতে হবে। কথায় বলে-
আপনাকে বড় বলে বড় সে নয়, লোকে যাকে বড় বলে, বড় সে হয়। সংসারেতে বড় হওয়া কঠিন ব্যাপার, সংসারেতে বড় হয় বড় গুণ যার। গুণেতে হলে বড়, বড় বলে সবে,
বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে।
অহঙ্কার মানুষের সমস্ত ইবাদতকে পুড়ে ফেলে। আজাজিল ফেরেশতা অহঙ্কার করার কারণে আল্লাহর রোষে অভিশপ্ত হয়ে ইবলিস শয়তান নামে পরিচিত হল। ফেরাউন নিজেকে অধিক ক্ষমতাবান বলে মনে করে অহঙ্কার করে দাবী করেছিল 'আমি তোমাদের বড় প্রভু।' (নাউজুবিল্লাহ)। আসলে সে যে কি পরিমাণ অসহায় দুর্বল ছিল, সে তা কল্পনাও করে নাই। অহঙ্কারের ভয়াবহ পরিণতি তাকে স্বাগতম জানাল। কাজেই আসমান জমিনের উপর একমাত্র আল্লাহ পাকেরই জন্য বড়ত্ব এবং গৌরব, আর কারো জন্য নয়।
চৌদ্দ দফা
এই দফায় প্রথম দফার আলোচনার মতোই শিরক সম্বন্ধে বলা হয়েছে, শিরক হচ্ছে সব চেয়ে বড় যুলুম এবং অমার্জনীয় অপরাধ।
আল্লাহ পাক নির্দেশ দিয়েছেন,
وَلَا تَجْعَلْ مَعَ اللَّهِ إِلَهَا آخَرَ فَتُلْقَى فِي جَهَنَّمَ مَلُوماً مَّدْحُوراً.
উচ্চারণ: ওয়ালাতাজ আল মাআল্লাহি ইলাহান আখারা ফাতুলকা ফী- জাহান্নামা, মালুমাম মাদহুল্লা।
অর্থ: আল্লাহর সাথে অপর কাউকেও মাবুদ বানাইওনা, তাহলে তুমি জাহান্নামে পতিত হবে। অতঃপর তুমি কঠিন মুসীবতে পড়ে অতিনিন্দিত হবে।
(সূরা বনী ইসরাইল, আয়াত, ৩৯)
যাদেরকে তুমি মাবুদ বানিয়ে নিবে, ওরা তোমার কোনই উপকারে আসবে না। হাশরের দিন যখন তারা শিরকের কারণে আযাব ভোগ করবে, তখন তারা তাদের সে তথাকথিত মাবুদের কাছে সাহায্য চেয়ে বলবে যে, দুনিয়ায় আমরা তোমাকে মাবুদ বানিয়ে সেজদা দিয়েছিলাম, তাই আজ আমরা কঠিন আযাব ভোগ করছি। আমাদেরকে উদ্ধার কর, তখন সেই পায়ে সেজদা ওয়ালা শয়তানেরা বলবে, আজ আমি তোমাদের কোনই সাহায্য করতে পারব না। আজ আমি নিজেই মুসীবতে আছি।
শিরককে দুই প্রকারে ভাগ করা হয়। একটি হলো শিরকে জলী বড় শিরক, অপরটি হলো শিরকে খফী। আল্লাহর সাথে সরাসরি কাউকেও শরীক করা হচ্ছে শিরকে জলী। যেমন মুর্তি পূজা, সূর্য পূজা, আগুন পূজা, মাজার পূজা, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সেজদা করা, আল্লাহ ছাড়া অপর কেউ গায়েব জানে বলে বিশ্বাস করা ইত্যাদি।
আর শিরকে খফী হচ্ছে, সেসব কাজ, যা শিরকে জলির ন্যায় মনে না হলেও উহাও কুফরী। যার অন্তরে আল্লাহর আযাবের ভয় নাই এবং আল্লাহর রহমতের আশাও নাই সে কাফের হয়ে যায়। আল্লাহ পাকের প্রতি দোষারোপ করলে, আল্লাহকে হিংসা করলে বা অত্যাচারী বললে অথবা আল্লাহর সমতুল্য অন্য কাউকে মনে করলে সে কাফের হয়ে যায়। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিন্দা কিংবা হিংসা করলে তার প্রতি কোন প্রকার দোষারোপ করলে কাফের হয়ে যাবে। অন্যান্য নবীগণকে এবং বেহেশত দোযখ, কেয়ামত হওয়া মিথ্যা জানলে ও এসব তুচ্ছ করলে কাফের হয়ে যাবে। কোরআন শরীফের কোন আয়াতকে মিথ্যা জানলে বা তুচ্ছ করলে কাফের হয়ে যাবে। হারাম জিনিসকে হালাল জানলে এবং হালালকে হারাম জানলে কাফের হবে। যদি কেউ বলে স্বয়ং আল্লাহ নামায পড়তে বললেও নামায পড়ব না তবে কাফের হবে। যদি কেউ বলে যে, আল্লাহ রাসুল ও শরীয়তের কোন ধার ধারি না তাহলেও সে কাফের হয়ে যাবে। যদি কেউ আযান শুনে বলে উহা মিথ্যা, কাফের হয়ে যাবে। দরগায় মান্নত করাও শিরক। কারও মাথার কসম খাওয়াও শিরক। তাই এই সকল পাপ হতে আমাদের প্রত্যেকের সতর্ক থাকতে হবে।
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুদিন পর মদীনায় গিয়ে *বিষয় সংবিধান নীতিমালা অর্পণ করেন। আর চরিত্র গঠনমূলক ধারাগুলি ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তিস্থাপন করবেন, তাই আল্লাহ পাক তার প্রিয় হাবীবকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে গোপন বৈঠকে রাষ্ট্রনীতি আলোচনা করে জটিল জিবরাইল (আঃ)-এর মারফত দান করেছেন। অতঃপর আমার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরজ করলেন, মাবুদ! আমি আবার কতদিন পরে আপনার কাছে আসব। আল্লাহ পাক বলেন, হাবীব। আপনি ইচ্ছা করলে এখানেই থেকে যেতে পারেন। অথবা দুনিয়াতেও ফিরে যেতে পারেন। সেটা আপনার ইচ্ছা। নবী বললেন, মাবুদ! আপনি আমাকে যে উদ্দেশ্যে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, আমার সে দায়িত্বপূর্ণ কাজ সবে মাত্র আরম্ভ হয়েছে, উহা উম্মতগণকে বুঝিয়ে না দিয়ে আমি কেমন করে থাকি। তাদিগকে আপনার কালাম মোতাবেক' আদেশ ও নিষেধসমূহ উত্তমরূপে শিক্ষা দিতে হবে। বাতেলকে সরিয়ে হককে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই দ্বীনের দাওয়াত সব জায়গায় না পৌঁছিয়ে আমি বেহেশতে বাস করেও মনে শান্তি পাব না আল্লাহ পাক বলেন, হাবীব! আপনাকে বেহেশতের যে সকল সুখ-শান্তিসমূহ দেখানো হল, উহার খোঁজ খবর আপনার উম্মতগণকে শুনাবেন। তাহলে আমার হুকুম পালন করতে তাদের আগ্রহ বাড়বে। আর জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তি আপনি যা স্বচক্ষে দেখলেন উহার
কারণসমূহ তাদের নিকট বর্ণনা করবেন। এতে তারা পাপ কাজ হতে বিরত থাকবে। এখন আপনি দুনিয়াতে চলে যান।
আপনার মোট নব্বই বছর দুনিয়াতে হায়াত শেষ হওয়ার পর আবার আমার সাক্ষাৎ পাবেন। আমার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়াতে আসার পর তেষট্টি বছর বয়সে যখন আজরাইল (আঃ) হাজির হলেন। নবী বললেন, ভাই আজরাইল, আমারতো তেষট্টি বছর বয়স হয়েছে। আমিতো আরো সাতাইস বছর পাওনা আছি। আজরাইল (আঃ) আল্লাহ পাকের নিকট জানালেন। আল্লাহ পাক বললেন, আমার বন্ধুকে জানিয়ে দাও, মেরাজের সফরে তার সাতাইশ বছর কেটেছিল। ঐ সাতাইশ আর তেষট্টি যোগ করলে নব্বই হয়ে যায়। আমার নবী মেরাজের থেকে আসার পথে হযরত মুসা (আঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ হয়ে যায়। তিনি বিশ্ব নবীকে খুশী দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ভাই আল্লাহ পাক আপনার উম্মতের জন্য কি কি তোহফা দান করলেন, তিনি খুশি হয়ে বললেন, আল্লাহ পাক আমার উম্মতের প্রতি তোহফা স্বরূপ পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ও বছরে ছয় মাস রোযা ফরজ করেছেন। ইহা শুনে মুসা (আঃ) বললেন, ভাই আপনার উম্মতেরা কিছুতেই এই বিরাট দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। যেহেতু তারা কমজুর ও কম হায়াতের অধিকারী হবে। রুজী রোযগারের কাজে ব্যস্ত থাকবে। পরিশেষে নাফরমান হয়ে দোযখে যাবে। আমার উম্মতের উপর দৈনিক মাত্র দুই ওয়াক্ত নামায, বছরে তিন দিন রোযা রাখার আদেশ ছিল, উহাই তারা সঠিকভাবে পালন করতে পারে নাই। আপনার দুর্বল উম্মতেরা 'কিরূপে এই বিরাট বোঝা বহন করবে। আপনি পুনরায় আল্লাহ পাকের দরবারে গিয়ে নামায রোযার পরিমাণ কমিয়ে আনেন। একথা শুনে উম্মতের কাণ্ডারী নবীজী উম্মতের ভবিষ্যৎ পরিণাম চিন্তা করে পুনরায় সিদরাতুল মুনতাহায় গিয়ে রফ রফে আরোহণ করে কাবা কাওছাইনে গিয়ে সিজদায় পড়ে গেলেন। মাওলার দরবারে নামায রোযার সংখ্যা কমিয়ে দেওয়ার প্রার্থনা জানালেন। আল্লাহ পাক পঞ্চাশ থেকে পাঁচ ওয়াক্ত ও ছয় মাস থেকে তিন মাস কমিয়ে দিলেন।
এবার পয়তাল্লিস ওয়াক্ত নামায ও তিন মাস রোযা নিয়ে আসার পরে মুসা (আঃ) আবার পাঠালেন। মুসা (আঃ)-এর এরুপ হুশিয়ারিতে উম্মতের দরদী নবী ঐ নামাযকে পাঁচ পাঁচ করে নয় বার আসা যাওয়া করে প্রতিবারে পাচ ওয়াক্ত করে পয়তাল্লিশ ওয়াক্ত কমিয়ে অবশেষে পাঁচ ওয়াক্ত নামায বছরে এক মাস রোযা মঞ্জুর করিয়ে আনলেন। কিন্তু উম্মতের নেকী কম হবে ভেবে দুঃখিত হলেন। যে হায় আমি কি করলাম। আল্লাহ পাক তার প্রিয় হাবীবের অন্তরের ব্যাথা বুঝে ঘোষণা করলেন, হে বন্ধু! আপনি চিন্তিত হবেন না। আমি পঞ্চাশ ওয়াক্তের নেকী পাঁচ ওয়াক্তের মধ্যে এনে দিলাম ছয় মাস রোযার নেকী আমি এক মাসের মধ্যে এনেদিলাম।।
( ৯ম পর্ব/শেষ পর্ব আসিতেছে ইনশাআল্লাহ)
No comments:
Post a Comment